কার্বোহাইড্রেট, যাহা কার্বস বা স্যাকারাইড হিসাবে পরিচিত। সুগার বা স্টার্চ হিসাবে কার্বোহাইড্রেট। খাদ্যের প্রধান উৎস এবং মানবদেহের সকল অঙ্গে শক্তি প্রদান করে থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এই তিনটি মৌলের সমন্বয়ে কার্বোহাইড্রেট গঠিত। একেই কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা বলে।
দুই ধরনের উপাদান দ্বারা কার্বোহাইড্রেট সাধারনত গঠিত হয়ে থাকে। একটা অ্যালডিহাইড এবং কিটোন। অ্যালডিহাইড হল কার্বন ও অক্সিজেন পরমানুর দ্বিবন্ধনযুক্ত এবং একটা হাইড্রোজেন পরমানু থাকে। অপরদিকে কিটোন হল কার্বন ও অক্সিজেনের দ্বিবন্ধন যুক্ত ও দুইটা হাইড্রোজেন পরমানুর সমন্বয়ে গঠিত শর্করা।
কার্বোহাইড্রেট ধরন
অনেক ধরনের কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মনো-স্যাকারাইড, ডাই-স্যাকারাইড ও পলি-স্যাকারাইড। এই তিন ধরনের স্যাকারাইড বা শর্করা মানবদেহ গঠন ও পুষ্টি সরবরাহে দারুন ভূমিকা পালন করে থাকে।
মনো-স্যাকারাইডস
মনো শব্দের অর্থ এক। মনো-স্যাকাইরাইডস হল চিনি বা সুগারের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম একক। যাকে আর ভাগ করা যায় না বা অবিভাজ্য বা অবিশ্লেষ্য মনো-স্যাকারাইডসের মধ্যে Fructose, Glucose , ল্যাক্টোজ ও গ্যালেকটোজ অন্তভুর্ক্ত । একটা কোষের শক্তির প্রধান উৎস হল Glucose । রক্তে যে সুগারের মাত্রা পরিমাপ করে তাকে Glucose হিসাবেই গন্য করা হয়। “ব্লাড সুগার” অর্থ রক্তের মধ্যে সুগারের পরিমাপকে বোঝানে হয়ে থাকে।
গ্যালোক্টোজ মানবদেহের জন্য উৎপন্ন হয়ে থাকে দুধ থেকে। এছাড়াও মনো-স্যাকাইডস হিসাবে শাক-সবজি ও ফলমূল থেকে Fructose শর্করা পেয়ে থাকি।
ডাই-স্যাকারাইডস
ডাই শব্দের অর্থ দুই। দুই অনু মনো-স্যাকারাইডস যুক্ত হয়ে ডাই-স্যাকারাইড গঠিত হয়। উদাহরন হিসাবে ল্যাক্টোজ, ম্যাল্টোজ, সুক্রোজ যেকোন দুইটা মিলিত হয়ে ডাই-স্যাকারাইডস সৃষ্টি করে থাকে। এক অনু গ্লুকোজের সাথে এক অনু গ্যালেক্টোজ বন্ধনীর মাধ্যমে ল্যাক্টোজ তৈরি হয়। সরাসরি ল্যাক্টোজ মিল্ক থেকে পাওয়া যায়। এক অনু গ্লুকোজের সাথে এক অনু ফ্রুক্টোজ মিলিত হয়ে সুক্রোজ অনু গঠন করে থাকে। সুক্রোজ পাওয়া যায় চিনি থেকে। কোন সবুজ উদ্ভিদের উপর যখন আলো পতিত হয় তখন ক্লোরোফিলের ফটোসিনথেসিসের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে টেবিল সুগার চিনি সৃষ্টি হয়।
পলি-স্যাকারাইডস
দুই বা ততোধিক মনো-স্যাকারাইডস অনুর সমন্বয়ে পলি-স্যাকারাইডস গঠন করে থাকে। মনো-স্যাকারাইডের শত শত বা হাজার হাজার চেইনের মাধ্যমে পলি-স্যাকারাইডস হয়। পলি-স্যাকারাইডস গাছের মত শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে থাকে। লম্বা দন্ডের ন্যায় সোজা বড় আকারের অনু অনু পলি-স্যাকারাইডস । মানবদেহে বা প্রানীর লিভারে গ্লাইকোজেন(Glycogen) হিসাবে পলি-স্যাকারাইডস সঞ্চয় থাকে। স্টার্চ হল Glucose পলিমার যা অ্যামিলোজ( amylase) এবং অ্যামাইলোপেক্টিন( amylopectin) দিয়ে তৈরি। চাল, গম, আলুতে প্রচুর পরিমানে স্টার্চ থাকে। স্টার্চ পানিতে দ্রবনীয় নয়। অ্যামাইলেজ এনজাইম( Amylase enzymes) প্রানীদেহে এই সকল পলি-স্যাকারাইডস পরিপাকে সাহায্য করে থাকে।
এই সকলের মধ্যে সেলুলোজ অন্যতম যাহা কাঠ, গাছ, পেপার, সুতা ইত্যাদি থেকে পেয়ে থাকি। এরা সবই পলি-স্যাকারাইডের অন্তভুর্ক্ত।
সহজ এবং জটিল কার্বস বা কার্বোহাইড্রেট
সাধারন ও জটিল কার্বোহাইড্রেট বা কার্বস সম্পর্কে অনেকে হয়তো শোনেন নাই। যে কার্বোহাইড্রেট এক অনু মনো-স্যাকারাইডস বা দুই অনু মনো-স্যাকারাইডস থাকে তাকে সহজ বা সাধারন কার্বোহাইড্রেট বলে। অপরদিকে পলি-স্যাকারাইডস হল জটিল কার্বোহাইড্রেট।
সরল কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা
সরল কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা সাধারনত শর্করার মনো এবং ডাই স্যাকারাইডের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে।
জটিল কার্বোহাইড্রেট
জটিল কার্বোহাইড্রেট সাধারনত পলি-স্যাকারাইডসের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়ে থাকে। এটি পরিপাকে অনেক সময় নিয়ে থাকে। ফলে শরীরে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি সরবরাহ করে থাকে। এই টাইপের কার্বোহাইড্রেট প্রচুর পরিমানে ভিটামিন, মিনারেলস, ইত্যদির যোগান দিয়ে থাকে। এই ধরনের শর্করা খাবারের মধ্যে ফল, শাকসবজি, ডাল, কাউনের চাল ইত্যাদি ফাইবার বিশিষ্ট হওয়ার কারনে পরিপাকে যথেষ্ঠ সময় নিয়ে থাকেন।
পুষ্টি ও কার্বোহাইড্রেট
রুটি, পাস্তা, মটরশুটি, আলু, ব্রান, চাল শর্করা সমৃদ্ধ খাবার। বেশিরভাগ কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারগুলিতে উচ্চ পরিমানে স্টার্ক থাকে। কার্বোহাইড্রেট হল মানুষ সহ বেশিরভাগ প্রাণীর শক্তির সর্বাধিক সাধারণ উৎস। আমাদের যদি প্রয়োজন হয় তবে আমরা ফ্যাট এবং প্রোটিন থেকে আমাদের সমস্ত শক্তি পেতে পারি। এক গ্রাম কার্বোহাইড্রেটে প্রায় 4 কিলোক্যালরি থাকে যা প্রোটিনের সমান পরিমাণ। এক গ্রাম ফ্যাটতে প্রায় 9 কিলোক্যালরি থাকে।
তবে কার্বোহাইড্রেটের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্য রয়েছে:
মস্তিষ্কে কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন, বিশেষত Glucose, কারণ নিউরনগুলি ফ্যাট পোড়াতে পারে না। ডায়েটরি ফাইবার পলিস্যাকারাইড দিয়ে তৈরি যা আমাদের দেহ হজম করে না।
ডায়াটারি একটা গাইডলাইন থেকে জানা যায় যে, ৪৫-৬৫% শক্তির যোগান হয় কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা খাবার থেকে, ১০% শক্তি পেয়ে থাকি সাধারন কার্বোহাইড্রেট থেকে। মানে মনো-স্যাকারাইডস বা ডাই স্যাকারাইডস থেকে।
ডায়েট শর্করা খাবার
উচ্চ বা নিম্ন কার্ব ডায়েটের প্রচুর প্রচারক ব্র্যান্ডেড এবং প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলিকে ওজন হ্রাস সহায়তা হিসাবে পুষ্টি বার, গুঁড়ো হিসাবে প্রচার করে। এইগুলো অস্বাস্থ্য খাবারের মতো রঙিন, কৃত্রিম মিষ্টি, ইমুলিফায়ার এবং অন্যান্য অ্যাডিটিভ থাকে। মার্কেটিং করে এই পন্য বিক্রি করাই যাদের মূল লক্ষন।কৃত্রিক ডায়েট প্রয়োগ করে প্রাকৃতিক দেহ রক্ষা করা অনেক কঠিন । তাই বাজারের এই সকল বিজ্ঞাপনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
ভোক্তাগন সেই সকল বিজ্ঞাপন দেখে নিজের ওজন হ্রাস করতে সেই সকল কৃত্রিম কার্বোহাইড্রেট গ্রহন করেন। অস্থায়ীভাবে কিছু ওজন হ্রাস হলেও পরে আবার সেই ওজন শরীরে এসে যুক্ত হয়। সাথে সাথে শরীরের ওজন আগের থেকে বেশি পরিমানে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
শর্করা ডায়াবেটিসে কি ভূমিকা পালন করে থেকে?
যখন কোন ব্যক্তি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার গ্রহন করে তখন আমার পরিপাকতন্ত্রে হাইড্রোক্লোরাইড এসিডের সাহায্য ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। তখন খাবার থেকে Glucose উৎপন্ন হয়। রক্তে প্রবেশ করার পর রক্তে Glucose-এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তখন অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ হয়।
ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন যা কোষে বা মানবদেহে শক্তি সরবরাহ করে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত Glucose লেভেল বেড়ে গেলে সঞ্চয় করতেও সাহায্য করে থাকে। এই কাজটি করে থাকে লিভারের আলফা কোষ।
যখন রক্তে শর্করার মাত্রা একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টের নীচে নেমে যায়, অগ্ন্যাশয়ের আলফা কোষগুলি glucagon ছেড়ে দেয়। glucagon হরমোন যা লিভারকে রিলিজ করে গ্লাইকোজেন, যা লিভারে সঞ্চিত চিনি।
ইনসুলিন ও glucagon রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। এই বিশেষ কাজটি করে থাকে কেন্দীয় স্নায়ু তন্ত্র। glucagon এর মাত্রা কমে গেলে তখন আবার সঞ্চয় করতে থাকেন আলফা কোষের মাধ্যমে। একটা নিদিষ্ট লেভেল Glucose সঞ্চয় করে রাখে পরবর্তি ব্যবহার করার জন্য, Glucose রিজার্ভ বলতে পারি আমরা।
যদি রক্তে Glucose এর মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাহলে ইনসুলিন নিঃসরন হয় না। তখন অগ্ন্যাশয়ে সমস্যা দেখা যায়। মানে বিটা সেলস যথেষ্ঠ পরিমান ইনসুলিন নিঃসরন করতে পারে না। একে বলা হয় ইনসুলিন প্রতিরোধক বলে।
ইনসুলিন কোষে প্রবেশ না করলে সমস্যা?
মানবদেহের কোষে ইনসুলিন প্রবেশ করতে না পারলে রক্তে সুগারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দেহে কোন প্রকার শক্তি উৎপন্ন হয় না। এই insulin resistance কারনে যে সকল সমস্যা সৃষ্টি হয় সেগুলোঃ
- উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন
- ফ্যাটি লেভেল বৃদ্ধি পাওয়া
- খারাপ কোলেস্টেরল লেভেল বৃদ্ধি
- দ্রুত ওজন বৃদ্ধি করা।
এছাড়াও, অনেক ক্রোনিক জাতীয় রোগের সমস্যা হয়ে থাকে। এই সকল সমস্যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সাথে সংযুক্ত।
সারাংশ
স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন তবে এগুলি অবশ্যই সঠিক ধরণের কার্বোহাইড্রেট হতে হবে। কোনও সুষম ডায়েট অনুসরণ কর যাতে সব ধরনের কার্বোহাইড্রেট অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং পর্যাপ্ত ঘুম এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপ পাওয়ার ফলে কোনও নির্দিষ্ট পুষ্টিকে কেন্দ্র করে বা বাদ দেওয়ার চেয়ে সুস্বাস্থ্য এবং উপযুক্ত শরীরের ওজন হতে পারে।
Discussion about this post